গণপরিসর বা কমিউনিটির মানুষের জন্য জায়গা না ছাড়লে ঢাকা শহরের সব এলাকায় ব্যক্তি পর্যায়ে আট তলার বেশি উঁচু আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে না। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন এবং সাভার পৌর এলাকাতেও আবাসিক ভবনের উচ্চতা হবে সর্বোচ্চ ছয় তলার।
এই প্রস্তাব করা হয়েছে ঢাকার নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ ২০১৬-২০৩৫) খসড়ায়। তবে এ প্রস্তাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে নগর পরিকল্পনাবিদ ও আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।
গত ২ সেপ্টেম্বর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুন ড্যাপের খসড়া আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে। এতে জনঘনত্ব অনুযায়ী ভবনের নির্দিষ্ট উচ্চতা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহসভাপতি সোহেল রানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেন আমরা ২০ তলায় যাবো না, ৩০ তলায় যাবো না? এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে আবাসন ব্যবসায় ধস নামবে। ভবনের উচ্চতা কম হলে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যায়। ফলে ঢাকায় আবাসন আর সাধারণ জনগণের নাগালের মধ্যে থাকবে না। ’
তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত নগর গবেষক ও সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের (নগর গবেষণাকেন্দ্র) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘এতে ব্যবসার খুব ক্ষতি হবে বলে আমার মনে হয় না। আট তলা কম কথা না। কেন্দ্রীয় ঢাকায় আর কোনোভাবেই ঘনত্ব বাড়ানো ঠিক হবে না।’
পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান ও ড্যাপ প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত রাজউক কর্মকর্তাদের মতে, ভবনের উচ্চতা বাড়লে ফ্ল্যাটের দামও বাড়ে। দুটো কারণে এটা হয়। প্রথমত উঁচু ভবন তৈরির সুযোগ থাকলে জমির দাম বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ে। ফলে ফ্ল্যাটের দামও বেড়ে যায়।
রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) আজহারুল ইসলাম খান নিউজবাংলাকে বলেন, এখন নতুন ড্যাপের বিভিন্ন দিক নিয়ে নগরের বাসিন্দাসহ অংশীজনদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। ৪ নভেম্বরের পর বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আলোচনায় বসা হবে। সবার পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতেই নতুন ড্যাপ চূড়ান্ত করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, এলাকাভেদে জনঘনত্ব অনুসারে ভবনের এই উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ এই শহরকে বাঁচানোর জন্য। এতে নাগরিক সেবার মান বাড়বে। পাশাপাশি এই পদ্ধতিতে ঢাকামুখী মানুষের স্রোতও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) দেওয়া তথ্য অনুসারে, ঢাকা এখন পৃথিবীর সর্বোচ্চ জনঘনত্বের শহর। মাত্র ৩২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই শহরে এখন প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ লোকের বাস। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনঘনত্ব প্রায় ৪৫ হাজার। পৃথিবীর কোনো মেগা সিটির জনঘনত্ব ঢাকার জনঘনত্বের কাছাকাছিও নয়।
বর্তমানে যে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আছে, সেখানে পুরো মহানগরের জন্য একই ধরনের ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে ঢাকার ভবনের উচ্চতা বেশি হয়েছে এবং জনঘনত্ব অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, ২০০৮ সালে প্রণীত ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা জমির আয়তন অনুসারে বেশি উচ্চতার আবাসিক ভবন নির্মাণের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এই বিধিমালা অনুসারেই ধানমন্ডিতে এখন ১৪ তলা ভবন নির্মাণ করা যায়। অথচ ১৯৯৬ সালের বিধিমালায় এখানে সর্বোচ্চ ছয় তলা ভবন নির্মাণের সুযোগ ছিল। কোনো এলাকার ধারণ ক্ষমতা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধার ভিত্তিতেই ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ হওয়া উচিত। এটা না হওয়ার কারণেই ঢাকার আজকের এই অবস্থা।
নতুন ড্যাপ প্রস্তাবে ঢাকা ও আশপাশের এলাকাগুলোকে মোট ৪৬৮টি কমিউনিটি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ব্লকের জনসংখ্যার ধারণক্ষমতা, সড়ক অবকাঠামো, নাগরিক সুবিধা ও উন্নয়নের ধরনের ওপর ভিত্তি করে আবাসিক ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে। যে ব্লকে নাগরিক সুবিধা বেশি, উন্মুক্ত জায়গার পরিমান বেশি, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো সেই ব্লকের ভবনের উচ্চতা বেশি ধরা হয়েছে।
এই হিসাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের খিলক্ষেত, কুড়িল, নিকুঞ্জ এলাকায় ৬ তলা; উত্তরায় ৭-৮ তলা; গুলশান, বনানী, বারিধারায় ৬-৮ তলা; মিরপুর এলাকায় ৪-৭ তলা; মোহাম্মদপুর-লালমাটিয়া এলাকায় ৫-৮ তলা উচ্চতার আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পুরান ঢাকায় ৪-৬ তলা উচ্চতার আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে। গাজীপুরের দু-একটি এলাকা ছাড়া বেশির ভাগ এলাকারই আবাসিক ভবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা হবে ৪-৬ তলা।
বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খানের মতে, আবাসিক ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া ছাড়া ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের উন্নত শহরগুলোতে উচ্চ মাত্রার জনঘনত্ব বলতে প্রতি একর জায়গায় ৭০-৮০ জন মানুষের বসবাস বোঝায়। সেখানে ঢাকায় বিভিন্ন ওয়ার্ডে একর প্রতি ৩০০ থেকে ৭০০, এমনকি ৮০০ মানুষও থাকে।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ব্লকভিত্তিক খোলা জায়গা চিহ্নিত করতে হবে। যদি খোলা জায়গা না থাকে তাহলে চারটা প্লট, আটটা প্লট রাজউক কিনে ফেলুক। যত টাকা লাগে।’
অবশ্য যে প্রক্রিয়ায় জনঘনত্বের বিষয়টা নির্ণয় করা হয়েছে তা নিয়ে আপত্তি আছে স্থপতি ও নগরবিদ ইকবাল হাবিবের। তাঁর মতে, পুরো পরিকল্পনাটা করা হয়েছে ‘অপরিপক্ক হাতে’। আর এটা নগর উন্নয়নের সার্বিকতার দিকটাকে ধারণ করতে পারেনি।
ইকবাল হাবিব বলেন, এই রকম একটা সিদ্ধান্ত দ্বিমাত্রিক নয় বরং ত্রিমাত্রিক পরিকল্পনার সাপেক্ষে নেওয়া উচিত ছিল। অর্থাৎ কোথায় কোন স্থাপনা কীভাবে হবে, এর আশপাশে কী কী থাকবে তার একটা মডেল উপস্থাপন করা জরুরি ছিল।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজউকের সঙ্গে খালি রিহ্যাব বসলে হবে না। পরিকল্পনাবিদেরা বসুক, স্থপতিরা বসুক, নগর গবেষকেরা বসুক। যাতে শহরটাকে বাঁচানো যায়। আর বার বার যেন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হয়।’